ঢাকা, ২১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার, ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১
good-food
১৩২৬

শেষ প্রস্থানে জাহাঙ্গীর ভাই-ও  

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২৩:০৩ ১৮ জুলাই ২০১৯  

শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমাদের প্রিয় জাহাঙ্গীর ভাই। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের গুণের   কোন শেষ নেই। অসাধারণ এক ব্যক্তি। মুখের হাসিটি অমলিন। একহারা গড়ন। খুব টিপটপ থাকতেন। সারাক্ষণ তার ভেতরে অস্থিরতা কাজ করতো।
কাজের উদ্যমে তিনি ছুটতেন। তিনি ছিলেন পরিকল্পনার রাজা। কত কিছুর পরিকল্পনা করতেন। তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই নিত্য নতুন ভাবনাগুলো আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। বহু গুণে গুণান্বিত এক মানুষ। 
তার সাফল্য বহুবিধ। তিনি দীর্ঘদিন পেশাদারী সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি মিডিয়া বিষয়ক কলাম লিখেছেন পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায়। প্রথম আলোয় খুব গুরুত্ব দিয়ে তার লেখা ছাপা হতো। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা ও বিচিত্রায় তার অসংখ্য ফিচার, নিবন্ধ ও রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। 

তিনি ছিলেন খ্যাতনামা টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। বিটিভিতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান তৈরি করেছেন। উপস্থাপনা করেছেন। মনে পড়ে একুশের সংকলন নিয়ে তিনিই দৈনিক বাংলার পেছন  পাতায় দীর্ঘ ফিচার লিখতেন। একুশের সংকলন নিয়ে টিভিতেও অনুষ্ঠান করতেন। টেলিভিশনে প্রথম সরাসরি সম্প্রচারিত টেলিফোন অনুষ্ঠান তিনিই প্রথম উপস্থাপন করেন। আপনি কি ভাবছেন বা বিষয়ভিত্তিক ‘অভিমত’ অনুষ্ঠান তিনি দীর্ঘদিন উপস্থাপনা করেছেন। 

তবে দীর্ঘ ১৪ বছর একটানা চ্যানেল আইয়ের পর্দায় প্রতি শুক্রবার সকালে লাইভ টেলিফোন অনুষ্ঠান টেলিসময় উপস্থাপনা করেছেন। সব কাজেই তিনি ছিলেন সিরিয়াস। অনুষ্ঠানটির নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন জামাল রেজা। নির্দিষ্ট দিনে তিনি আমাদের বিষয় বলে দিতেন। আমরা যেন প্রমোশনাল দেই সেই ব্যাপারে তাগাদা দিতেন। অন এয়ারের দিন একঘন্টা আগে উপস্থিত হতেন। হাতে ফাইল আর অনুষ্ঠানে কি বলবেন তা লিখা থাকতো। লিখিত ডকুমেন্ট ছাড়া জাহাঙ্গীর ভাই কোনো মুখের কথার গুরুত্ব দিতেন না। প্রচুর চিরকুট লিখতেন। তাতে বিভিন্ন নির্দেশনামা থাকতো। একদিন হাসতে হাসতে বললেন, চিরকুট না লিখলে আমরা যা বলি তা অস্বীকারও করি। কিংবা ভুলে যাই। তাই চিরকুট লিখে দেই। 

এই সৎগুণটি তিনি পেয়েছিলেন নোবেল জয়ী তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে। এই ভ্রাতার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা। তার জীবনের আইকন। তার আদর্শ। প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গে তিনি গর্বের সঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের কথা বলতেন। 
যা বলছিলাম টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন খুব ধীর স্থির শান্ত স্বভাবের মডারেটর হিসাবে তিনি ছিলেন অসম্ভব দক্ষ। নিজে কথা কম বলতেন। আলোচকদের কথা বলার সুযোগ দিতেন। যে ব্যক্তিত্ব যে বিষয়ে অভিজ্ঞ ও জানাশোনা আছে তিনি তাদেরই নিতেন। যিনি অর্থনীতি জানেন তাকে সাহিত্য বিষয়ক আলোচনায় নিতেন না। জাহাঙ্গীর ভাইকে কখনো ভুলভাবে প্রভাবিত করা যেত না। 

শেষ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিতেন। তার মতামতের সঙ্গে অমিল হলে তিনি সে কাজে অংশ নিতেন না। নিজের সমূহ ক্ষতি হবে জেনেও আপস করতেন না। 
বইমেলা সরাসরি যে অনুষ্ঠানটি এখনো আমরা প্রতিদিন বইমেলায় প্রচার করে থাকি। সেই অনুষ্ঠনের আইডিয়া দিয়েছিলেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। ২০০৬ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের উপস্থাপনায় বইমেলা সরাসরি প্রথম অন এয়ার হয়। 
চ্যানেল আইয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান তিনি উপস্থাপনা করেন। ‘মিডিয়া ভাবনা’ নামেও একটি অনুষ্ঠান দীর্ঘদিন প্রচারিত হয় তার নেতৃত্বে। 

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর দৈনিক বাংলায় সাংবাদিকতা দিয়ে জীবন শুরু করেন। প্রেস ইন্সটিটিউট এর পরিচালক হিসাবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। নানামুখী সামাজিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। 
দুচারটি তথ্য না দিলেই নয়। বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় তিনি ঢাকার প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছেন। ‘বক্তব্য’ নামে একটি চিন্তামূলক পত্রিকা প্রকাশ করেন দীর্ঘদিন। নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় নির্বাহী হিসাবে সংযুক্ত ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। প্রায় ৪৮ বছর। 

জাহাঙ্গীর ভাই নৃত্যকলার চর্চা বুদ্ধির জন্য শিবলী, নিপাকে সঙ্গে নিয়ে সংগঠন করেছেন। অনেক রকম কাজ করতেন ‘নৃত্যাঙ্গন’ এর মাধ্যমে। থিয়েটার নাট্য সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নিজে অভিনয় করতেন না। কিন্তু নাট্য সংগঠনের অন্যান্য কাজে সংযুক্ত থাকতেন। এক জীবনে তিনি কত যে সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছেন সে হিসাব কেউ করতে পারতেন না। 
এছাড়াও মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর খুব একাডেমিক ছিলেন। সাংবাদিকতা, লেখালেখি এসব নিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন ছিল। মনে পড়ে চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডের নীতিমালা তিনি লিখে দিয়েছিলেন। 
প্রয়াত চলচ্চিত্রকার ফজলুল হক স্মৃতি কমিটির তিনি ছিলেন আহবায়ক। আমি ছিলাম নির্বাহী সদস্য। কী অসাধারণ গদ্যে তিনি সংক্ষেপে ফজলুল হকের জীবনী লিখে দিয়েছিলেন। প্রতি বছর স্মৃতি পুরস্কারের উদ্বোধন করতেন তিনি। এ বছর আর উপস্থিত থাকবেন না তিনি। 

জীবনের গল্প বিভাগের পাঠকপ্রিয় খবর